ঢাকা ১২ই এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে চৈত্র, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৪২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২১
ধর্ম ডেস্ক: বিদ্রোহী কবি নজরুলের সুরে বলি- ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, আদিকাল থেকে আজকের যে সভ্যতা তাতে নারী-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। সভ্যতা বিনির্মাণে কারো অবদানই কম নয়। নারীর বিপরীত শব্দ পুরুষ। কিন্তু প্রতিপক্ষ নয়।
যেমনটা শারীরিক, শক্তিমত্তা, চালচলন, বেশভূষা ইত্যাদিতে বিপরীত। যার কারণ পুরুষরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আহার জোগাড় করে সংসারের জন্য। অন্যদিকে নারী সংসারকে তার আপন হাতে সাজিয়ে রাখে, যত্ন নেয়, সন্তান লালন-পালন করে।
সংসারই তার রাজ্য, কর্মক্ষেত্র। যেখানে সে রাজ করে, গড়ে তোলে নিজ সাম্রাজ্য। প্রশ্ন হলো তবে কি নারীর অগ্রগতি কিংবা উন্নয়ন প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে, তবে উন্নয়ন অর্থ যদি হয় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা, তাহলে উন্নয়নের নামে বিবস্ত্রপনা, বেপর্দা ও অবাধ বিচরণের কি প্রয়োজন থাকে? পর্দার উপস্থিতি কি কোনোভাবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান,
শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়াকে রোধ করে? তবে হ্যাঁ, উন্নয়নের অর্থ যদি হয় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিশ্চিত করা, ইয়াবাসহ মাদক সেবন, লিভ টুগেদার, উলঙ্গপ্রায় হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, বিয়ের আগেই সন্তানের মা হওয়ার অধিকার, তবে একমাত্র ইসলামই এ অধিকারের অন্তরায়।
একবার নয়, হাজারবার ইসলাম সে প্রগতির প্রধান বাধা। নারী উন্নয়ন মানে কি পর্দা ছাড়তে হবে? তবে পর্দা কি নারী উন্নয়নের একমাত্র অন্তরায়? উত্তরটি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার কাছেই জানুন, ‘উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে বোরকা ছাড়িতে বলেন।
বলি, উন্নতি জিনিসটা কী? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তা-ই হয়, তবে কি বুঝিব যে, জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?’ (মতিচূর প্রথম খণ্ড, বোরকা : ৫৯-৬৩) নারীবাদী হয়েও কেন হিজাব ও বোরকা পরেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়েমেনের বিশ্ববিখ্যাত নারীবাদী নেতা,
নোবেল বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান আরো সুন্দর করে বলেছেন : ‘আদিম যুগে মানুষ থাকত প্রায় নগ্ন হয়ে। তার বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সে পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে শুরু করে। আজ আমি যা হয়েছি তা মানুষের অর্জিত ধ্যান-ধারণা ও সভ্যতার সর্বোচ্চ পর্যায়। এটা পশ্চাদ্গামিতা নয়। পোশাক-পরিচ্ছদ অপসারণ সেই আদিম যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। সেটাই পশ্চাদ্গামিতা।’ (উইকিপিডিয়া)
পবিত্র কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা তোমাদের ঘরের (বাড়ির চতুর্সীমানার) ভেতর অবস্থান কর এবং বাইরে বের হয়ো না।
যেমনিভাবে ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগের মেয়েরা বের হতো।’ (সুরা আহযাব, আয়াত : ৪৩)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : ‘(হে নবী!) আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, যখন কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়, তখন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়।
এমনকি চেহারাও যেন খোলা না রাখে। তারা যেন বড় চাদরের ঘোমটা দ্বারা নিজেদের চেহারাকে আবৃত করে রাখে।) ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা আহযাব, আয়াত : ৬০)
তাহলে প্রশ্ন আসে, ইসলাম কি তবে নারী উন্নয়ন ও প্রগতির পথে বাধা? এর উত্তরও নিন বেগম রোকেয়ার ভাষায়- ‘জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার-অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রীজাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসীগণ কন্যা হত্যা করিতেছিল।
তখন হযরত মুহাম্মদ কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাঁহার জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন- কন্যা কিরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল। আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা।’ (অর্ধাঙ্গী, মতিচূর, প্রথম খণ্ড-৪৮)
চলুন তবে এবার একটু ইতিহাস দেখি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি ইসলামপূর্ব ধর্মগুলোও যখন নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি। দেখেছে কেবলই ভোগবস্তু হিসেবে। সেই চরম সংকটকালেই নারীমুক্তির আলোকবর্তিকা নিয়ে বিশ্বমানবতার কাছে হাজির হলেন হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
জাহেলিয়াতের যুগে জীবন্ত কন্যাশিশুকে কবর দেওয়ার মতো ঘৃণ্য, বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডকে বন্ধ করে ঘোষণা করলেন নারীর পদতলে সন্তানের বেহেশত। শুধু তা-ই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে নারীকে দিলেন পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার। অন্যদিকে সভ্য দুনিয়ার ইতিহাস দেখুন : ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে নারীকে পুড়িয়ে মারার আইন রদ করা হয় ১৭৩৬ সালে।
হিন্দু নারীরা আজো বঞ্চিত উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে। ১৮৮২ সলের গধৎৎরবফ ডড়সবহ’ং চৎড়ঢ়বৎঃু অপঃ ১৮৮২-এর আগে ব্রিটিশ আইনে নারীর সম্পত্তিতে ছিল না কোনো অধিকার। বিবাহপূর্ব সময়ে নারীর উপার্জিত সম্পদের মালিকানা বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত তার স্বামীর হাতে। (সূত্র : উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া)
তথাকথিত গণতন্ত্র আর অধিকারের ফেনা তোলা সেই আমেরিকা ১৭৭৬ সালে যখন স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র লিখছিল, সেই স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাপত্রেও ছিল না নারীর কোনো অধিকারের কথা। বঞ্চিতই ছিল নারীর অধিকার।
কিন্তু এর ১৪০০ বছর আগেই মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন দৃপ্তকণ্ঠে। হিন্দুধর্মের হাত ধরে সমাজে চালু হয়েছে অভিশপ্ত যৌতুক প্রথা।
রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮২৯ সালে হিন্দু নারীদের স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে মারা নিষিদ্ধ হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৬ সালে আইনগতভাবে বিধবা বিবাহ সিদ্ধ হয়।
কিন্তু এরও ১২৬০ বছর আগে মহান সংস্কারক আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বিধবাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বিধবাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তথাকথিত ‘নারী দিবস’ আর নারীর অধিকারের কথা বলে রাস্তায় নামিয়ে আনা যেন পুরুষদের সম্পর্কটা শিয়াল আর মোরগের গল্পের মতো। এক শিয়াল আর এক মোরগ দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিল। বন্ধু বলে শিয়াল মোরগকে কীভাবে খাবে, তাই ফন্দি আঁটল যে তারা হজে যাবে। তো যাত্রাপথে বিশ্রাম নিল দুজনে রাতের বেলা।
ফজর হতেই মোরগ ডাক দিল, যেটা তার চিরায়ত নিয়ম। কিন্তু এই ডাকে শিয়ালের ঘুম ভেঙে গেল, বলল তুই আমার ঘুম নষ্ট করলি কেন? শিয়াল মহা রেগে গিয়ে মোরগটাকে খেয়ে ফেলল। নারীর সমান অধিকারের কথা বলা মানুষরাও এমনি।
তারা বলে, নারী তুমি বেরিয়ে আসো। তোমার কামোদ শরীরের ভাঁজ দেখিয়ে আমার প্রলুব্ধ করো। আর আমরা তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।
অথচ ইসলাম বলে : ‘যে ব্যক্তির কন্যাসন্তান আছে, আর যে তাকে জ্যান্ত কবরস্থ করেনি কিংবা তার সাথে লাঞ্ছনাকর আচরণ করেনি এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর অগ্রাধিকার দেয়নি, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪৮) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :
‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তান লালন পালন করেছে, তাদেরকে উত্তম আচরণ শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সাথে সদয় আচরণ করেছে সে জান্নাত লাভ করবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪৯) নারীদের প্রতি কোমল ব্যবহারের গুরুত্ব প্রকাশ করে পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে : ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিছ হবে।
আর তোমরা তাদেরকে আবদ্ধ করে রেখো না, তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে তোমরা কিছু নিয়ে নেয়ার জন্য, তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর (সদয় আচরণ কর)।
আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোনো কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯) দিনশেষে নারীমুক্তির কথা বলি কিংবা নারীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা বলি, ইসলামই একমাত্র শাশ্বত মুক্তির দিশারি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : আবু সাঈদ সজল
হেড অফিস: আনন্দ প্লাজা (২য় তলা) মজিদপুর রোড, সাভার, ঢাকা-১৩৪০।
আঞ্চলিক অফিস: ইসলাম টাওয়ার, মির্জাপুর, রাজশাহী-৬২০৬।
মোবাইল : +৮৮-০১৭৯১৪৯৯৭০৯( সম্পাদক ) , +৮৮-০১৭০০৭৮২৯৫২ (বার্তা কক্ষ)
ই-মেইল : dailyalokitovor@gmail.com
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৮-২০২১ | Developed By Bongshai IT